পূর্ববর্তী সংবাদ
প্রতিবাদের আগুনে জ্বলছে নরসিংদী
হরতালে ট্রেনে আগুন, মহাসড়ক অবরোধ, আতঙ্ক উদ্বেগ ক্ষোভ
সাখাওয়াত কাওসার, নরসিংদী থেকে
নরসিংদীর পৌর মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেনের হত্যা ঘটনার পর থেকে পুরো শহর ভুতুড়ে। হরতালের কারণে গতকাল দিনভর নরসিংদী শহর ছিল থমথমে। তবে নিহতের জানাজা ও দাফনের জন্য সকাল থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টার জন্য হরতাল শিথিল করা হয়। পরে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শহর ছাত্রলীগ ৭২ ঘণ্টার হরতাল প্রত্যাহার করলেও সাধারণ মানুষের চোখেমুখে ছিল আতঙ্ক, উদ্বেগ আর ক্ষোভ। শহরের বিভিন্ন স্থানে টায়ার ও গাছের গুঁড়িতে আগুন ধরিয়ে বিক্ষোভ করেছে তারা। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কিশোরগঞ্জগামী এগারোসিন্দুর ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ লোকজন। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে এর আগেই ভস্মীভূত হয় ১৪টি বগি। হরতাল শিথিল হলেও শহর এলাকায় সকাল থেকে দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল বন্ধ। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত খোলা থাকলেও উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম। বন্ধ ছিল যান চলাচল। মেয়র হত্যার প্রতিবাদে দিনভর শহরের বিভিন্ন স্থানে খণ্ড খণ্ড মিছিল করেছে জেলা ছাত্রলীগ। দুপুরে পৌর মেয়রের লাশ নরসিংদীর বাসাইলে নিজ বাসভবনে আনা হলে মানুষের ঢল নামে। এ সময় তার কর্মী-সমর্থকরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। বিকালে তিন দফা জানাজা শেষে লোকমানকে দাফন করা হয় তারই প্রতিষ্ঠিত পৌর কবরস্থানে।
এদিকে অপ্রীতিকর ঘটনা ও সংঘর্ষ এড়াতে মঙ্গলবার রাত থেকেই শহরের প্রতিটি মোড়ে মোতায়েন করা হয় বিপুলসংখ্যক পুলিশ। শহরজুড়ে টহল দেয় আইনশৃক্সখলা বাহিনীর সদস্যরা। র্যাব, পুলিশ ও সিআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় পরিদর্শন করেন। জড়িত সন্দেহে নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক এমপি খায়রুল কবির খোকনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ। এ প্রতিবেদন তৈরি পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো মামলা হয়নি। তবে তাকে সন্দেহভাজন গ্রেফতার দেখিয়ে গতকাল নরসিংদী কারাগারে পাঠানো হয়েছে। খায়রুল কবির খোকনকে গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বিএনপি। নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ নিন্দা জানান দলের দফতর সম্পাদক রুহুল কবির রিজভী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ঘোষণা দিয়েছেন, মেয়র লোকমানের হত্যাকারী যত শক্তিশালীই হোক, তাকে গ্রেফতার করা হবে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এদিকে পৌর মেয়র হত্যার প্রতিবাদে আজ দেশের প্রতিটি পৌরসভায় এক ঘণ্টার কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছে মিউনিসিপ্যালিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ।
যেভাবে হত্যাকাণ্ড : প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সদর রোডে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আসেন পৌর মেয়র লোকমান হোসেন। এর কিছু আগে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মতিন ভূঁইয়া সেখানে উপস্থিত হন। একে একে আওয়ামী লীগের আরও ১২-১৩ জন নেতা-কর্মী সেখানে আসেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন লোকমান। ঠিক সাড়ে ৭টার দিকে কার্যালয়ে হঠাৎ ঢুকে পড়ে মুখোশধারী তিন যুবক। প্রায় একই আকৃতির তিন যুবক কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই খুব কাছ থেকে লোকমানকে লক্ষ্য করে চারটি গুলি ছোড়ে। গুলি পৌর মেয়রের বুকে, পেটে ও হাতে বিদ্ধ হলে তিনি চেয়ার থেকে নিচে পড়ে যান। প্রায় একই সময় বাইরে অপেক্ষমাণ মুখোশধারী আরও দুই যুবক অস্ত্র উঁচিয়ে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে আশপাশে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। প্রত্যক্ষদর্শী পান-দোকানি জব্বার মিয়া বলেন, মাত্র এক মিনিটেরও কম সময়ে অপারেশন শেষ করে ১০০ গজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেলে ঘাতকরা পালিয়ে যায়। পেশাদার ও ভাড়াটে খুনিরাই হত্যা করেছে পৌর মেয়র লোকমান হোসেনকে, এমনটা মনে করেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
ভাঙল রাতের নিস্তব্ধতা
ঘটনার পর গুরুতর আহত অবস্থায় মেয়র লোকমানকে সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে রাত ১১টায় কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ খবর শুনে হাজার হাজার মানুষ রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে রাস্তায় নেমে আসে। শুরু হয় অবরোধ, ভাঙচুর আর অগি্নসংযোগ। রাত ৯টার দিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ অবরোধ করে যান ও ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয় বিক্ষোভকারীরা। এ সময় মহাসড়কে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে। প্রায় অর্ধশত গাড়ি, বেশ কিছু দোকানপাট এবং সার্কিট হাউসে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় বিক্ষোভকারীরা। সার্কিট হাউসের আসবাবপত্র প্রধান ফটকের বাইরে এনে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। ৭২ ঘণ্টা হরতালের ডাকে জেলা ছাত্রলীগ।
এদিকে শহরের বাসাইল এলাকায় লোকমানের বাসায় গতকাল গিয়ে দেখা যায়, নিহতের মা মজিদা খাতুন ও স্ত্রী বুলবুলি আক্তার বাকরুদ্ধ। মাঝেমধ্যেই চিৎকার করে স্ত্রী বলছিলেন, 'আমার স্বামী মরতে পারে না। আমি তা বিশ্বাস করি না। এই তো কিছুক্ষণ আগেই সে আমার বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা করেছে। আমার সন্তানরা এখন কাকে বাবা বলে ডাকবে!' তার কান্না দেখে আগতদের কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
খুনের নেপথ্যে : পরপর দুবার পৌর নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠতে থাকেন লোকমান হোসেন। পুরো নরসিংদী জেলায় তার ইমেজ ছড়িয়ে পড়ে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রায়পুরা আসন থেকে প্রার্থী হতে পারেন বলে তাকে নিয়ে আতঙ্কে ছিলেন বর্তমান এমপি, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দীন আহমেদ রাজু। এ ছাড়া সম্প্রতি ছাত্রলীগের জেলা কমিটি গঠন নিয়ে টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজুর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন মেয়র লোকমান হোসেন। সুপারিশ না রাখায় লোকমান হোসেনের ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন মন্ত্রী।
এদিকে ১৫ অক্টোবর দুপুরে নরসিংদী সরকারি কলেজের ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রেহানুল ইসলাম লেলিনের (মন্ত্রী রাজুর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত) ওপর হামলার জের ধরে মন্ত্রী ও লোকমানের মধ্যে দূরত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পরে ২২ অক্টোবর জেলা ছাত্রলীগ কলেজে ও শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কে মন্ত্রী রাজুর বিরুদ্ধে জুতা-মিছিল করে। মিছিলে নেতৃত্ব দেন লোকমানের ছোট ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজ। পরে জেলা প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে নরসিংদীতে মন্ত্রীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে ছাত্রলীগ।
অন্যদিকে সমপ্রতি সিঅ্যান্ডবির জায়গায় অর্ধশতাধিক দোকান নির্মাণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দূরত্ব বাড়তে থাকে মন্ত্রী রাজু ও লোকমানের মধ্যে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, শহরের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখলেও লোকমানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসীদের মদদদানের কিছু অভিযোগ ছিল। আওয়ামী লীগ নেতা হয়েও বিএনপির সাবেক মহাসচিব মরহুম মান্নান ভূঁইয়ার সঙ্গে একসময় তার ছিল দহরম-মহরম সম্পর্ক। হত্যার শিকার হওয়ার আগ পর্যন্ত ওই সম্পর্ক তিনি অব্যাহত রেখেছিলেন জেলা বিএনপি সভাপতি খায়রুল কবীর খোকনের সঙ্গে। এ ছাড়া কমিশনার মানিক, নুরুজ্জামান নুরা ও ইমরান হত্যার নেপথ্যে মেয়র লোকমানের হাত আছে বলে অভিযোগ ছিল। সব মিলিয়ে ঘরে-বাইরে শত্রু তৈরি করেছিলেন মেয়র লোকমান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় বাসিন্দা ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক ঘণ্টা আগেই মন্ত্রী ঘনিষ্ঠ হাজি আবদুর সাত্তার ও সালাহউদ্দিন বাচ্চু আত্মগোপন করেন। তাদের মুঠোফোনের কল-লিস্ট ঘাঁটলে ঘটনা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য পাওয়া যেতে পারে বলে জানিয়েছেন তারা। ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি কাইয়ূম সরকার জানান, সরকার আন্তরিক হলে এ ঘটনার রহস্য শিগগিরই বের করা সম্ভব।
পুলিশি তৎপরতা : মঙ্গলবার রাতে ওই ঘটনার পরপরই তদন্তে নেমেছে আইনশৃক্সখলা বাহিনীর সদস্যরা। ওই রাতেই পুলিশ, র্যাব ও সিআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তবে ঘটনাস্থল থেকে কোনো আলামত উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। এমনিক গুলির খোসাও উদ্ধার করতে পারেনি তারা।
জেলা পুলিশ সুপার আক্কাস উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, হত্যাকাণ্ডে ঘাতকরা উন্নত মানের অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এর ফলে ঘটনাস্থলে গুলির খোসা পাওয়া যায়নি। ঘাতকদের শনাক্ত করতে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি টিম মাঠে নেমেছে বলে তিনি জানান। ঘটনার পর থেকে পুরো শহরের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
জানাজা ও দাফন : শোকের মাতমে স্তব্ধ নরসিংদী। অশ্রুসিক্ত চোখে মেয়রকে চিরবিদায় জানালেন নরসিংদীবাসী। বিকাল ৪টায় (বাদ আসর) জেলা স্টেডিয়াম প্রাঙ্গণ, পৌরসভা প্রাঙ্গণ ও জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে লাখো জনতার অংশগ্রহণে তিন দফা জানাজা হয়। এরপর পৌর কবরস্থানে লোকমান হোসেনকে দাফন করা হয়। জানাজায় অংশ নেন আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব-উল আলম হানিফ ও বাহাউদ্দিন নাসিম। এ ছাড়া স্থানীয় এমপি আনোয়ারুল আশরাফ দিলীপসহ স্থানীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে মেয়র লোকমান হত্যার তীব্র নিন্দা ও ঘাতকদের গ্রেফতার দাবি জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) কাজী মাহমুদ হাসান, জেলা সভাপতি শফিকুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান।
এদিকে অপ্রীতিকর ঘটনা ও সংঘর্ষ এড়াতে মঙ্গলবার রাত থেকেই শহরের প্রতিটি মোড়ে মোতায়েন করা হয় বিপুলসংখ্যক পুলিশ। শহরজুড়ে টহল দেয় আইনশৃক্সখলা বাহিনীর সদস্যরা। র্যাব, পুলিশ ও সিআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় পরিদর্শন করেন। জড়িত সন্দেহে নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক এমপি খায়রুল কবির খোকনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ। এ প্রতিবেদন তৈরি পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো মামলা হয়নি। তবে তাকে সন্দেহভাজন গ্রেফতার দেখিয়ে গতকাল নরসিংদী কারাগারে পাঠানো হয়েছে। খায়রুল কবির খোকনকে গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বিএনপি। নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ নিন্দা জানান দলের দফতর সম্পাদক রুহুল কবির রিজভী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ঘোষণা দিয়েছেন, মেয়র লোকমানের হত্যাকারী যত শক্তিশালীই হোক, তাকে গ্রেফতার করা হবে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এদিকে পৌর মেয়র হত্যার প্রতিবাদে আজ দেশের প্রতিটি পৌরসভায় এক ঘণ্টার কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছে মিউনিসিপ্যালিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ।
যেভাবে হত্যাকাণ্ড : প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সদর রোডে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আসেন পৌর মেয়র লোকমান হোসেন। এর কিছু আগে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মতিন ভূঁইয়া সেখানে উপস্থিত হন। একে একে আওয়ামী লীগের আরও ১২-১৩ জন নেতা-কর্মী সেখানে আসেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন লোকমান। ঠিক সাড়ে ৭টার দিকে কার্যালয়ে হঠাৎ ঢুকে পড়ে মুখোশধারী তিন যুবক। প্রায় একই আকৃতির তিন যুবক কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই খুব কাছ থেকে লোকমানকে লক্ষ্য করে চারটি গুলি ছোড়ে। গুলি পৌর মেয়রের বুকে, পেটে ও হাতে বিদ্ধ হলে তিনি চেয়ার থেকে নিচে পড়ে যান। প্রায় একই সময় বাইরে অপেক্ষমাণ মুখোশধারী আরও দুই যুবক অস্ত্র উঁচিয়ে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে আশপাশে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। প্রত্যক্ষদর্শী পান-দোকানি জব্বার মিয়া বলেন, মাত্র এক মিনিটেরও কম সময়ে অপারেশন শেষ করে ১০০ গজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেলে ঘাতকরা পালিয়ে যায়। পেশাদার ও ভাড়াটে খুনিরাই হত্যা করেছে পৌর মেয়র লোকমান হোসেনকে, এমনটা মনে করেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
ভাঙল রাতের নিস্তব্ধতা
ঘটনার পর গুরুতর আহত অবস্থায় মেয়র লোকমানকে সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে রাত ১১টায় কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ খবর শুনে হাজার হাজার মানুষ রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে রাস্তায় নেমে আসে। শুরু হয় অবরোধ, ভাঙচুর আর অগি্নসংযোগ। রাত ৯টার দিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ অবরোধ করে যান ও ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয় বিক্ষোভকারীরা। এ সময় মহাসড়কে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে। প্রায় অর্ধশত গাড়ি, বেশ কিছু দোকানপাট এবং সার্কিট হাউসে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় বিক্ষোভকারীরা। সার্কিট হাউসের আসবাবপত্র প্রধান ফটকের বাইরে এনে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। ৭২ ঘণ্টা হরতালের ডাকে জেলা ছাত্রলীগ।
এদিকে শহরের বাসাইল এলাকায় লোকমানের বাসায় গতকাল গিয়ে দেখা যায়, নিহতের মা মজিদা খাতুন ও স্ত্রী বুলবুলি আক্তার বাকরুদ্ধ। মাঝেমধ্যেই চিৎকার করে স্ত্রী বলছিলেন, 'আমার স্বামী মরতে পারে না। আমি তা বিশ্বাস করি না। এই তো কিছুক্ষণ আগেই সে আমার বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা করেছে। আমার সন্তানরা এখন কাকে বাবা বলে ডাকবে!' তার কান্না দেখে আগতদের কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
খুনের নেপথ্যে : পরপর দুবার পৌর নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠতে থাকেন লোকমান হোসেন। পুরো নরসিংদী জেলায় তার ইমেজ ছড়িয়ে পড়ে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রায়পুরা আসন থেকে প্রার্থী হতে পারেন বলে তাকে নিয়ে আতঙ্কে ছিলেন বর্তমান এমপি, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দীন আহমেদ রাজু। এ ছাড়া সম্প্রতি ছাত্রলীগের জেলা কমিটি গঠন নিয়ে টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজুর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন মেয়র লোকমান হোসেন। সুপারিশ না রাখায় লোকমান হোসেনের ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন মন্ত্রী।
এদিকে ১৫ অক্টোবর দুপুরে নরসিংদী সরকারি কলেজের ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রেহানুল ইসলাম লেলিনের (মন্ত্রী রাজুর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত) ওপর হামলার জের ধরে মন্ত্রী ও লোকমানের মধ্যে দূরত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পরে ২২ অক্টোবর জেলা ছাত্রলীগ কলেজে ও শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কে মন্ত্রী রাজুর বিরুদ্ধে জুতা-মিছিল করে। মিছিলে নেতৃত্ব দেন লোকমানের ছোট ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজ। পরে জেলা প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে নরসিংদীতে মন্ত্রীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে ছাত্রলীগ।
অন্যদিকে সমপ্রতি সিঅ্যান্ডবির জায়গায় অর্ধশতাধিক দোকান নির্মাণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দূরত্ব বাড়তে থাকে মন্ত্রী রাজু ও লোকমানের মধ্যে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, শহরের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখলেও লোকমানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসীদের মদদদানের কিছু অভিযোগ ছিল। আওয়ামী লীগ নেতা হয়েও বিএনপির সাবেক মহাসচিব মরহুম মান্নান ভূঁইয়ার সঙ্গে একসময় তার ছিল দহরম-মহরম সম্পর্ক। হত্যার শিকার হওয়ার আগ পর্যন্ত ওই সম্পর্ক তিনি অব্যাহত রেখেছিলেন জেলা বিএনপি সভাপতি খায়রুল কবীর খোকনের সঙ্গে। এ ছাড়া কমিশনার মানিক, নুরুজ্জামান নুরা ও ইমরান হত্যার নেপথ্যে মেয়র লোকমানের হাত আছে বলে অভিযোগ ছিল। সব মিলিয়ে ঘরে-বাইরে শত্রু তৈরি করেছিলেন মেয়র লোকমান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় বাসিন্দা ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক ঘণ্টা আগেই মন্ত্রী ঘনিষ্ঠ হাজি আবদুর সাত্তার ও সালাহউদ্দিন বাচ্চু আত্মগোপন করেন। তাদের মুঠোফোনের কল-লিস্ট ঘাঁটলে ঘটনা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য পাওয়া যেতে পারে বলে জানিয়েছেন তারা। ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি কাইয়ূম সরকার জানান, সরকার আন্তরিক হলে এ ঘটনার রহস্য শিগগিরই বের করা সম্ভব।
পুলিশি তৎপরতা : মঙ্গলবার রাতে ওই ঘটনার পরপরই তদন্তে নেমেছে আইনশৃক্সখলা বাহিনীর সদস্যরা। ওই রাতেই পুলিশ, র্যাব ও সিআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তবে ঘটনাস্থল থেকে কোনো আলামত উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। এমনিক গুলির খোসাও উদ্ধার করতে পারেনি তারা।
জেলা পুলিশ সুপার আক্কাস উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, হত্যাকাণ্ডে ঘাতকরা উন্নত মানের অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এর ফলে ঘটনাস্থলে গুলির খোসা পাওয়া যায়নি। ঘাতকদের শনাক্ত করতে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি টিম মাঠে নেমেছে বলে তিনি জানান। ঘটনার পর থেকে পুরো শহরের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
জানাজা ও দাফন : শোকের মাতমে স্তব্ধ নরসিংদী। অশ্রুসিক্ত চোখে মেয়রকে চিরবিদায় জানালেন নরসিংদীবাসী। বিকাল ৪টায় (বাদ আসর) জেলা স্টেডিয়াম প্রাঙ্গণ, পৌরসভা প্রাঙ্গণ ও জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে লাখো জনতার অংশগ্রহণে তিন দফা জানাজা হয়। এরপর পৌর কবরস্থানে লোকমান হোসেনকে দাফন করা হয়। জানাজায় অংশ নেন আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব-উল আলম হানিফ ও বাহাউদ্দিন নাসিম। এ ছাড়া স্থানীয় এমপি আনোয়ারুল আশরাফ দিলীপসহ স্থানীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে মেয়র লোকমান হত্যার তীব্র নিন্দা ও ঘাতকদের গ্রেফতার দাবি জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) কাজী মাহমুদ হাসান, জেলা সভাপতি শফিকুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান।
0 comments:
Post a Comment