কয়েকজন জোটনেতার যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার নেওয়ার দাবি তুলেছেন সরকারদলীয় সাংসদরা।
বুধবার জাতীয় সংসদে আলোচনায় অংশ নিয়ে খালেদাকে উদ্দেশ্য করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, "আপনার কথা বলার দরকার হলে সিদ্ধান্ত প্রস্তাব নিয়ে আরেকটি প্রস্তাব আনতে পারেন। আজ বিচার শুরু হয়েছে। কিন্তু এ অবস্থায় আপনি বিষোদ্গার করছেন।"
"সংসদে গৃহীত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা জনগণকে অবমাননা করছেন" বলে উল্লেখ করেন সুরঞ্জিত।
তিনি বলেন, "আপনি অপরাধ করেছেন। এই সংসদ থেকে কোর্ট অব রেকর্ড হিসেবে ওই অপরাধীর (বিরোধীদলীয় নেত্রী) বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিন।"
"বর্তমান সরকারকে এ দেশের মানুষ ও তরুণ প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য নির্বাচিত করেছে" উল্লেখ করে তিনি বলেন, "সে বিচারটি করার জন্য আজ দেশ প্রস্তুত।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ক্ষমতাসীন মহাজোটের অন্য সাংসদরাও খালেদার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান। তারা যুদ্ধাপরাধ বিচার সম্পন্ন করতে নতুন প্রজন্মকে নিরঙ্কুশভাবে জেগে ওঠারও আহবান জানান।
অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী। আলোচনা হয় এক ঘণ্টার বেশি।
যুদ্ধাপরাধ বিচার প্রসঙ্গে খালেদা জিয়ার দেওয়া বক্তব্য নিয়ে সংসদে আলোচনার জন্য বুধবার সংসদে জরুরি জনগুরুত্বসম্পন্ন নোটিস আনেন সরকারি দলের জ্যেষ্ঠ সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
নোটিসে তিনি ছাড়াও রাশেদ খান মেনন, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ফজলে রাব্বী মিয়া, অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ ও রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম স্বাক্ষর করেন।
চলতি মাসে সিলেট ও রাজশাহীতে চার দলের সমাবেশে খালেদা জিয়া একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, নায়েবে আমীর দেলওয়ার হোসাইন সাঈদী, সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা, বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মুক্তি দাবি করেন।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে গতবছরের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল, আইনজীবী প্যানেল ও তদন্ত সংস্থা গঠন করে সরকার।
আটক জামায়াত-বিএনপি নেতাদের মধ্যে জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়েছে গত ৩ অক্টোবর।
<ন>'রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হওয়া উচিত'
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালকে প্রশ্নবিদ্ধ করায় বিরোধীদলীয় নেত্রীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন।
তিনি বলেন, "সংসদকে পাস কাটিয়ে, সংসদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।"
বিভিন্ন সময়ে বক্তব্যে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালকে 'দলীয়' বলে অভিহিত করেছেন খালেদা জিয়া।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, "দেশের জনগণ জানে, বিশ্ববাসী জানে নিজামী সাঈদীরা যুদ্ধাপরাধী। সেখানে খালেদার যদি লজ্জা থেকে থাকে, তবে কীভাবে বলেন তারা যুদ্ধাপরাধী নন।"
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করে তার কার্যকলাপের জবাব দেওয়ার আহ্বান জানান তোফায়েল।
আমির হোসেন আমু বলেন, "জিয়াউর রহমান যাদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছেন তাদের পথ অনুসরণ করছেন খালেদা জিয়া। তিনি তার ছেলেকে ও যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্যে কাজ করছেন।"
বিরোধী নেত্রীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, "সংসদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে রোড মার্চ করছেন, সংসদে না এসে সংসদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন।"
"এই সংসদকে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে তিনি যা খুশি তাই বলে যাবেন।"
<ন>'তাহলে যুদ্ধাপরাধী কে'
বিরোধীদলীয় নেত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করে আবদুল মান্নান বলেন, "নিজামী, সাঈদী যদি যুদ্ধাপরাধী না হয়, তবে কি জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধী? এ বিষয়টা স্পষ্ট করতে হবে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে।"
চলতি মাসে দুই সমাবেশে খালেদা বলেন, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, দেলওয়ার হোসাইন সাঈদী, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা যুদ্ধাপরাধী নন।
ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, "যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তিযোদ্ধা বানানোর অপচেষ্টা করছেন বিরোধীদলীয় নেত্রী।"
তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক নান্নু বলেন, "স্বাধীনতার ৪০ বছরে কোনো সরকারই যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে পারে নি। আর যখন বিচার কাজ শুরু হয়েছে তখন তা বাধা গ্রস্ত করার চেষ্টা চলছে।"
বিরোধীদলীয় নেত্রীকে উদ্দেশ্য করে জাসদের মঈনউদ্দিন খান বাদল জানান, "মানুষ আপনি যা করছেন, বলছেন, যে সর্বনাশা পথে অগ্রসর হয়েছে, এদেশের মানুষ তা সমর্থন করছে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই।"
বিরোধীদলীয় নেত্রীকে সংসদে এসে কথা বলার আহ্বান জানান তিনি।
অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ বলেন, "যারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কথা বলছেন, বিরোধী দলীয় রাজাকার, আলবদরের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন- এ প্রেক্ষাপটে তিনি লিপ্ত হয়েছেন গণতন্ত্রের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। অর্থবহ স্বাধীনতাকে অর্থহীন করার অপপ্রয়াসে নেমেছেন।"
সংসদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় বিরোধী দলীয় নেত্রীর প্রতি নিন্দা ও সমালোচনা করেন এবং এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
<ন>'তার বক্তব্য আস্তাকুঁড়ে যাবে'
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, "বেগম জিয়া মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি, তিনি জানেন না বোঝেন না মুক্তিযুদ্ধ কী।"
"যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় দলিলাদি ও স্বাক্ষী সংগ্রহ করতে গিয়ে বর্তমান সরকার সময় বেশি নিয়েছে", বলেন মুহিত।
"বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচার চালিয়ে যাবে, মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত অধ্যায় শেষ করা হবে।" মন্তব্য করে অর্থমন্ত্রী বলেন, "বিরোধীদলীয় নেত্রীর বক্তব্য ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে যাবে।"
শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, "যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে আগুন জ্বলবে- তার [খালেদার] এ বক্তব্য বাংলার মানুষ সহ্য করবে না।"
তিনি প্রশ্ন করেন, "নিজামী, সাঈদী যুদ্ধাপরাধী না হলে কারা যুদ্ধাপরাধী? তারা হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ করেছে, বুদ্ধিজীবী হত্যা করেছে- তারা যুদ্ধাপরাধী না হলে কারা যুদ্ধাপরাধী?"
খালেদা জিয়ার সমালোচনা করে মতিয়া চৌধুরী বলেন, "[বিএনপি আমলে] যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য শহীদ জননী যখন এগোচ্ছেন, সরকারের থেকে শহীদ জননীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করা হয়।"
"স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার সখ্যতা অনেক আগে থেকেই", যোগ করেন মতিয়া।
তিনি বলেন, "সা¤প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান করে দিয়েছেন জিয়াউর রহমান। যেমন জামাই, তেমন বউ। খালেদা জিয়া কে, কী, কার মা- তা আজ স্পষ্ট।"
খালেদাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, "আপনি আলবদর, আলসামস, স্বাধীনতা ও মুক্তিযোদ্ধার বিরোধী শক্তির মা।"
<ন>নতুন প্রজন্মকে জেগে ওঠার আহ্বান
নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে সুরঞ্জিত বলেন, "নতুন প্রজন্ম তোমরা জেগে উঠো। যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে নিরঙ্কুশভাবে দাঁড়াতে হবে। মানবতাবিরোধীদের ক্ষমা নেই। এ দেশে তাদের বিচার হবে।"
আলোচনায় আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, "যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করতে নেতৃত্ব দেবে তরুণ প্রজন্ম। মুক্তিযুদ্ধের পর এবার আরেকটি যুদ্ধের নেতৃত্ব দেবে তারাই। যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ বাধা গ্রস্ত করতে চায় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তাদের রুখবে এ প্রজন্ম।"
"আগামী ৩০ অক্টোবর একজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার কাজ শুরু হচ্ছে। ৭/৮ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারও শুরু হওয়ার পথে। আন্তর্জাতিকভাবে এ বিচার প্রক্রিয়া স্বীকৃত।", যোগ করেন প্রতিমন্ত্রী।
এ অবস্থায় বিরোধীদলীয় নেত্রী পরিকল্পিতভাবে বিচার কাজকে বাধাগ্রস্ত করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।