সেনা মোতায়েন না হওয়ায় মধ্যরাতে বিএনপির 'নির্বাচন বর্জনের' ঘোষণার পর কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে ভোট শুরু হয়েছে নারায়ণগঞ্জে।
এ নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন বলেন, রোববার নির্ধারিত সময় সকাল ৮টায় নবগঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। চলবে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। এ উপলক্ষে নির্বাচনী এলাকায় সাধারণ ছুটি রয়েছে।
সবকিছু শান্তিপূর্ণভাবেই চলছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে ভোট শুরুর মাত্র ৭ ঘণ্টা আগে শনিবার মধ্যরাতে বিএনপি ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে এ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়ায় ভোটারদের মধ্যে তৈরি হয়েছে খানিকটা অনিশ্চয়তাও। তবে তারা বলছেন, যাই ঘটুক, পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভোট দিতে যাবেন তারা।
শনিবার রাত পৌনে ১টায় জরুরি প্রেস ব্রিফিংয়ে নির্বাচন বর্জনের কথা বলেন বিএনপির সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল নোমান।
তিনি বলেন, "নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা হয়নি। ভোটারদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে হুমকি দেওয়া হযেছে। এ পরিস্থিতিতে আমার নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করছি এবং আমাদের প্রার্থীকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে বিরত রাখছি।"
একই সঙ্গে বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগও দাবি করেন তিনি।
এর পরপরই বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার জানান, নেত্রীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে তার নির্দেশে নির্বাচন 'বর্জন' করছেন তিনি।
এদিকে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে উল্লে¬খ করে রিটার্নিং কর্মকর্তা বিশ্বাস লুৎফুর রহমান জানান, সুষ্ঠু নির্বাচনে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছি। নির্ভয়ে ভোট কেন্দ্রে আসবে, নিরাপদে ফিরবেন। এখানে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে" বলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
র্যাব অনিয়ম ঠেকাতে প্রথমবারের মতো ভোটকেন্দ্রেও যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে রিটার্নিং কর্মকর্তা।
ছয় মেয়র প্রার্থী: এ নির্বাচনে মেয়র পদে দেয়াল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের শামীম ওসমান, দোয়াত কলম প্রতীক নিয়ে সেলিনা হায়াত আইভি, আনারস প্রতীক নিয়ে বিএনপি'র তৈমুর আলম খন্দকার, গরুর গাড়ি প্রতীক নিয়ে ইসলামী আন্দোলনের আতিকুর রহমান নান্নু মুন্সী এবং নির্দলীয় প্রার্থী শরীফ মোহাম্মদ হাঁস প্রতীক নিয়ে ও আতিকুল ইসলাম জীবন তালা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের কথা দলের পক্ষ থেকে বলা হলেও নির্বাচন থেকে প্রার্থীর সরে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ আর নেই বলে জানান নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন।
"মনোনয়ন প্রত্যাহারের সময় শেষ হওয়ার পর কারো নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ঘোষণা দিলেও ব্যালটে তার প্রতীক থাকবে এবং তিনি প্রার্থী হিসেবে গণিত হবে।"
নবগঠিত এ সিটি করপোরেশনে চার লাখ চার হাজার একশ' ৮৯ জন ভোটার ছয় মেয়র প্রার্থী, সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৫৬ জন ও সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৫০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
রিটার্নিং কর্মকর্তা এ নির্বাচনে নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় নয়জন সহকারি রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ প্রায় সাড়ে তিন হাজার নির্বাচন কর্মকর্তা নিয়োচিত রয়েছে।
নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন জানান, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে আমরা বদ্ধ পরিকর। অনিয়ম ঠেকাতে আমরা হার্ডলাইনে। যে কোনোভাবেই এ নির্বাচন ভালো করতে হবে।
যে কোনো অনিয়ম ঠেকাতে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান ছহুল।
এ নির্বাচনের আট হাজারেরও বেশি আইন শৃঙ্খরা বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত রয়েছে। এরমধ্যে পুলিশ ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন চার হাজার, আনসার ও ভিডিসি সদস্য আড়াই হাজার, র্যাব ১৪০০ রয়েছে। এয়াড়া প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ২৪ জন করে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য দায়িত্ব পালন করছে।
নির্বাচনী এলাকার ২৭টি ওয়োর্ডেও প্রতিটিতে একজন করে নির্বাহী হাকিম, নয় জন বিচারিক হাকিম, ২৭ জন ইসির পর্যবেক্ষক, ২৭টি ভ্রাম্যমান ভিডিও ক্যামেরা, ২০টি কেন্দ্রে প্রথমবারের মতো সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।
লিখিতভাবে না জানিয়ে বের হওয়ার সুযোগ
সহকারি রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন জানান, কেন্দ্রে কোনো ধরনের বাহানা দেখিয়ে কোনো পোলিং এজেন্ট প্রিজাইডিং বা সহকারি প্রিজাইডিং কর্মকর্তা না জানিয়ে কেন্দ্র থেকে বেরোতে পারবে না। লিখিতভাবে তাদের জানাতে হবে।
ইসি মনিটরিং করবে পরিস্থিতি
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে বসে সিসিটিভি'র মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২০টি ভোটকেন্দ্র মনিটরিং করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচনের ইতিহাসে এবারেই প্রথম এনসিসি নির্বাচনে ২০টি কেন্দ্রে সিসিটিভি ব্যবহার করছে ইসি। এসব কেন্দ্রের সিসিটিভি পর্যবেক্ষণের জন্য নারায়ণগঞ্জ শহীদ জিয়া হলেও একটি মনিটরিং প্যানেল বসানো হয়েছে।
এ নির্বাচনে দেশি-বিদেশি পাঁচশ' মতো পর্যবেক্ষক রয়েছে।
নারয়ণগঞ্জে প্রথম
এ নির্বাচনে ভোটের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে প্রথমবারের মতো ২০টি কেন্দ্রে সিসিটিভ ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।
সহকারি রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন জানান, সবক'টি ওয়ার্ডের প্রতিনিধিত্ব রেখে তিনটি থানায় এসব ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।
কেন্দ্রগুলো হচ্ছে- ১ নম্বর ওয়ার্ডের ১ নম্বরে কন্দ্র, ২ নম্বর ওয়ার্ডের ১৫ নম্বরে কন্দ্র, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ৩০ নম্বরে কন্দ্র, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ৩৩ নম্বরে কন্দ্র, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ৩৮ নম্বরে কন্দ্র, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ৪৯ নম্বর কেন্দ্র, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ৫৫ নম্বরে কন্দ্র, ১০ নম্বর ওয়ার্ডের ৬০ নম্বরে কন্দ্র, ১২ নম্বর ওয়ার্ডের ৭১ নম্বর কেন্দ্র, ১২ নম্বর ওয়ার্ডের ৭৩ নম্বর কেন্দ্র, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের ৮০ নম্বর কেন্দ্র, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের ১০৩ নম্বর কেন্দ্র, ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের ১১৩ নম্বরে কন্দ্র, ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের ১১৯ নম্বর কেন্দ্র, ২০ নম্বর ওয়ার্ডের ১২৭ নম্বর কেন্দ্র, ২২ নম্বর ওয়ার্ডের ১৩৭ নম্বরে কন্দ্র, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের ১৪৫ নম্বরে কন্দ্র, ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের ১৫৮ নম্বর কেন্দ্র এবং ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের ১৬২ নম্বরে কন্দ্র।
এনসিসি নির্বাচনে প্রথম বারের মতো প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয় তদারকিতে 'মনিটরিং কমিটি গঠন' করা হয়েছে। এ কমিটি প্রতি সাতদিন পর পর প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয় পর্যালোচনা করে দেখছে।
সিটি করপোরেশনের তিনটি থানায় প্রার্থী ও ভোটারদের অভিযোগ যথাযথভাবে পুলিশ নিচ্ছে কিনা- তা সমন্বয় করতে ইসির তিনজন কর্মকর্তা লিয়াঁজো কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে।
ইভিএম ৯ ওয়ার্ডে
দেশে দ্বিতীয় বারের মতো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার হচ্ছে এ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে।
নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে দৃঢ়, ফল ঘোষণা তাড়াতাড়ি করা, নির্বাচনোত্তর সহিংসতা কমানো, নির্বাচন পরিচালনা ব্যয় কমানো ও প্রশাসনিক জটিলতা কমানোসহ আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইভিএম'র উদ্যোগ নেয় ইসি।
২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৯টি ওয়ার্ডের (৭, ৮, ৯, ১৬, ১৭, ১৮, ২২, ২৩, ২৪) মোট ৫৮ কেন্দ্রের ৪৫০টি বুথে একটি করে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে।
এসব ওয়ার্ডের ভোটার রয়েছে এক লাখ ৪৮ হাজার ৬২৯ জন।
এর আগে গত বছরের জুনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মাত্র একটি ওয়ার্ডে (চট্টগ্রাম মহানগরীর জামালখান রোড এলাকার ২১ নম্বর ওয়ার্ডে।) ইভিএম ব্যবহার হয়।
এ ওয়ার্ডের ১৪টি ভোটকেন্দ্রের ৭৯টি ভাটকক্ষ একটি করে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। এতে ভোটর ছিলেন ২৫ হাজার ২৩০ জন।
এক নজরে এনসিসি'র তথ্য
গত ২২ সেপ্টেম্বর এ সিটি করপোরেশনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। তফসিল অনুযায়ী, ৩০ অক্টোবর ভোটের আগে ২ অক্টোবর মনোনয় দাখিলের শেষ দিন, প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিল ১২ অক্টেবর।
এ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা ইসি সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব বিশ্বাস লুৎফুর রহমান ৯ জন সহকারি রিটার্নিং কর্মকর্তা নির্বাচন পরিচালনা করছেন।
এ সিটি করপোরেশনে সাধারণ ওয়ার্ড ২৭টি ও সংরক্ষিত ওয়ার্ড ৯টি। এ নির্বাচনী এলাকার ৪ লাখ ৪ হাজার ১৮৯ ভোটারের মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৩ হাজার ৩৪৪ জন ও মহিলা ২ লাখ ৮৪৫ জন।
৩১২ প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীর মধ্যে মেয়র পদে ৬ প্রার্থী , সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৫০ প্রার্থী ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৫৬ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
ভোটকেন্দ্র ১৬৩টি ও ভোটকক্ষ ১২১৭টি। এর বিপরীতে ১৬৩ প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, ১২১৭ সহকারি প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ও ২৪৩৪ জন পোলিং কর্মকর্তা ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত থাকবেন।