নিজভূমে পরবাসী ৫
ভারতের ভিতরকুঠি ছিটমহলের মেঠো পথে হেঁটে যেতে যেতে প্রকৃতির অপরূপ শোভা মন ভরিয়ে দেয়। বাঁশের ঘন ঝোপ, বিশাল বৃক্ষ, বিস্তৃত ধান ক্ষেত সেই চিরায়ত বাংলার স্নিগ্ধ প্রকৃতির মাঝেই এখানকার মানুষদের বসবাস। কিন্তু এদের মাঝে স্নিগ্ধ জীবনের কোন স্পর্শ নেই। এ ছিটমহলে বিদ্যুত্ সংযোগ না থাকায় সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যায় পুরো গ্রাম। এই অন্ধকারের চাইতেও গভীর অন্ধকারে ঢাকা এ ছিটমহল বাসিন্দাদের জীবন। দিনের তীব্র আলো সে অন্ধকার দূর করতে পারে না। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতার কারণে সবসময় অনিশ্চয়তা, হীনমন্যতা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন ভিতরকুটি ছিটমহলবাসী। ভারতীয় নাগরিক হয়েও মৌলিক অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। জীবন ধারণের জন্য প্রতিনিয়ত নির্ভরশীল বাংলাদেশের ওপর।
‘ভারত হামাক কোন সুবিধা দেয় নাই। হামরা বন্দি হয়া আছি। কোন দেশত পাত্তা পাই না। হামার ছাওয়া-পোয়ার ন্যাখাপড়ার ব্যবস্থা নাই। হামরা ভারতের নাগরিক হয়াও স্যাটে যাবার পারি না। ওটে কাঁটাতারের ব্যাড়া দিছে। হামরা বাংলাদেশত থাইকপার চাই’— বলছিলেন এ ছিটমহলের অধিবাসী আমিনুল ইসলাম। শুধু আমিনুল ইসলামই নন ভিতরকুঠি ছিটমহলে বসবাসকারী প্রায় সবাই বাংলাদেশের নাগরিক হতে চায়। কারণ এ ছিটমহলটি ভারতের অংশ হলেও এখানে বসবাসকারী কেউই ভারতে যেতে পারেন না। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা ভারতের সীমানা। তারা বলেন, দীর্ঘ কয়েক দশকে তারা পুরোপুরি বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে মিশে গেছেন। সে কারণে তারা বাংলাদেশের নাগরিক হতে চান। এ ছিটমহলের দেড় হাজার বাসিন্দা জীবন-জীবিকা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা সবকিছুর জন্যই নির্ভর করে বাংলাদেশের ওপর। এখানে যেমন কোন চিকিত্সালয় নেই, তেমনি নেই কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেহেতু ভারত সরকারের ছিটমহল সে জন্য বাংলাদেশের কোন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের অংশ হতে পারেন না তারা। আবার কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আলাদা থাকায় ভারতের নাগরিক হবার কোন সুযোগও পান না তারা। তাই অস্তিত্ব রক্ষায় বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে নিজেদের আলাদা পরিচয়পত্র করাচ্ছেন তারা। বাংলাদেশের স্কুল-কলেজগুলোতে লেখাপড়া করছে শিশুরা। প্রতিটি ঘরে ঘরে বাংলাদেশের মোবাইল ফোন। শুধু তাই নয়, এখানকার ২৮০ জন বাংলাদেশের হয়ে ভোটারও হয়েছেন।
এ ছিটমহলে নেই কোন বাজার-হাটও। এখানকার মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও ওষুধ কেনেন লালমনিরহাটের কুলাঘাট, বড়বাড়ি, নয়ারহাট থেকে।
ভারতীয় ছিটমহলের অধিবাসীরা জানান, বাংলাদেশের মানুষের সহযোগিতা না পেলে তারা এখানে বেঁচে থাকতে পারতেন না। প্রত্যেকে বাংলাদেশের মানুষের সহানুভূতির কথা উল্লেখ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন আর আবেদন জানান, এ ছিটমহলকে বাংলাদেশের অংশ করে নেবার জন্য। কেউ কেউ এ ছিটমহলকে বাংলাদেশের অংশ না করা হলে আন্দোলন গড়ে তোলার কথাও উল্লেখ করেন।
আমিনুল ইসলাম জানান, তিনি নামমাত্রে ভারতীয়। ভিতরকুঠি ছিটমহলে তার বসবাস হলেও বিয়ে করেছেন লালমনিরহাট জেলার শিউলি বেগমকে। বাংলাদেশের অধিবাসী হিসাবে জাতীয় পরিচয়পত্র করিয়ে চাকরিও করছেন একটি আধা-সরকারি অফিসে। শুধু আমিনুল নন এখানকার অধিকাংশ তরুণ-তরুণী বাংলাদেশীদের বিয়ে করতে আগ্রহী। কারণ, এতে তার বাংলাদেশে কাজ করতে সুবিধা হয়। যে কোনভাবে বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে পরিচয় দেবার একটি সূত্র মেলে।
ইছিম উদ্দিন ভিতরকুঠিতে বসবাস করছেন দেশ বিভাগের আগে থেকে। বিয়ে করেছেন লালমনিরহাট জেলার মিভিরকুঠি গ্রামে। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নাম বলতে না পারলেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম জানেন। তিনি বলেন, এখন ভারতে যেতেই আমাদের পাসপোর্ট লাগবে। বাংলাদেশের মানুষ আমাদের সঙ্গে সদয় আচরণ করে।
ভিতরকুঠির বাসিন্দা নবম শ্রেণীর ছাত্রী মুন্নি আক্তারের সঙ্গে কথা হয় তার স্কুলে যাবার পথে। লালমনিরহাটের কুলাঘাট হাই স্কুলের ছাত্রী সে। আমরা ছিটমহলের বাসিন্দা বলে স্কুলের ছেলেমেয়েরা আমাদের বিদ্রুপ করে। মুন্নি জানায়, তাদের বাংলাদেশী হিসাবে স্বীকৃতি দিলে লেখাপড়াসহ চাকরি ও সংসার সবকিছুতেই সুবিধা হয়। মুন্নির সহপাঠী আফসানা আক্তার আশা জানায়, আমরা ভারতের অধিবাসী কিন্তু ভারতে প্রবেশে আমরা বাধা পাই। অথচ বাংলাদেশে প্রবেশে কোন বাধা নেই।
Ads by Cash-71
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment