SPORTS JOBS 7WONDERS

Ads by Cash-71

সৌদিতে শিরশ্ছেদ স্বজনদের ঘরে ঘরে আহাজারি

Posted by methun

'আমার মতির লাশ আইন্যা দ্যাও, নাইলে আমাকে মাইর‌্যা ফেলাও। মতিরে ছাড়া আমি বাঁচুম না। তোমরা মতিরে আমার কাছে আইন্যা দ্যাও।' এমন বিলাপ এখন আর শুধু মতিয়ারের মা সুফিয়া বেগমের একার নয়, একই দৃশ্য সৌদি আরবে শিরশ্ছেদ হওয়া আট বাংলাদেশির প্রত্যেকের বাড়িতে। ২০০৭ সালের এপ্রিলে একটি গুদামে ডাকাতি এবং সেখানকার নিরাপত্তাকর্মী এক মিসরীয়কে হত্যার অভিযোগে শুক্রবার ওই আট বাংলাদেশির শিরশ্ছেদ করে সেখানকার সরকার। এই আটজনের মধ্যে সুমন মিয়া, শফিকুল ইসলাম, মাসুদ ও মামুনের বাড়ি টাঙ্গাইল জেলায়। বাকি চারজনের মধ্যে মতিয়ার রহমান ও আবুলের বাড়ি ফরিদপুরে, সুমন-২-এর কিশোরগঞ্জ ও ফারুকের বাড়ি কুমিল্লায়। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :

টাঙ্গাইল : 'টাকার লোভে আমি ক্যান আমার বাবারে সৌদি পাঠাইলাম। তোমরা আমার শফিকরে আইনা দাও।' এভাবেই বিলাপ করছিলেন আর বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন শিরশ্ছেদের শিকার হতভাগ্য যুবক শফিকুল ইসলামের (২৫) মা রওশন আরা বেগম (৫০)। শফিক সখীপুর উপজেলার ভাতকুড়াচালা গ্রামের খুয়াজ উদ্দিনের ছেলে। তার শিরশ্ছেদের খবর পেঁৗছলে এলাকায় গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে। মা-বাবা, ভাইবোনদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। আশপাশের গ্রামের শত শত নারী-পুরুষ তাদের বাড়িতে ভিড় জমায়। তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে শফিক ছিলেন চতুর্থ। পাঁচ বছর আগে জমিজমা বিক্রি ও ধারকর্জ করে তাকে সৌদি আরবে পাঠানো হয়। এক বছর আগে সর্বশেষ শফিক দেশে এসেছিলেন। দেলদুয়ার উপজেলার বারপাখিয়া গ্রামে শিরশ্ছেদ হওয়া সুমন মিয়ার (২৫) বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। মা জিলিমন বেগম পুত্রশোকে বিলাপ করছিলেন। জিলিমন বেগম কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না ছেলের এমন মৃত্যু। আশপাশের পরিবেশ এতটাই ভারি ছিল যে, সেভাবে কাউকেই কথা বলার জন্য পাওয়া যাচ্ছিল না। সুমন মিয়ার মামা আবু বকর জানালেন, মিসরীয়কে হত্যার অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত ১১ আসামির মধ্যে সুমনও গ্রেফতার হয়ে জেদ্দা জেলহাজতে ছিলেন। ১৫ দিন আগে তিনি বাড়ির সবার সঙ্গে শেষবারের মতো মোবাইলে কথা বলেন। বুধবার সুমন মামা আবু বকরকে জানান, শীঘ্রই তার শিরচ্ছেদ করা হবে। তিনি তার জন্য দোয়া করতে বলেন। কিন্তু বাড়ির সদস্যরা মোটেই অনুমান করতে পারেননি যে এত তাড়াতাড়ি শিরশ্ছেদের ঘটনা ঘটবে।

শোকের মাতম চলছে কালিহাতী উপজেলার কস্তুরিপাড়া গ্রামের মাসুদের (২৬) বাড়িতেও। আট বছর আগে শামছুল হকের ছেলে মাসুদকে জমিজমা বিক্রি করে সৌদি আরবে পাঠানো হয়। পাঁচ বছর আগের হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার হয়ে এতদিন তাকে জেলে দিন কাটাতে হয়। সাত দিন আগে মাসুদ বাবাকে টেলিফোনে বলেন, 'আমি ভালো আছি, আমার জন্য দোয়া করো।' মাসুদের শিরশ্ছেদের খবর পেঁৗছার পর থেকে মা রোকেয়া বেগম (৫০) অচেতন। বাবা ও ভাইবোনেরা সবাই বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন।

'আমার বাবারে নেওয়ার আগে ক্যান আমারে নিলা না। আমারে শ্যাষ কইরা দ্যাও।' এভাবেই প্রলাপ বকছিলেন আর বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন হতভাগা মামুনের মা মাজেদা বেগম (৫৫)। আর বড় ভাই হারুন ছোট ভাইয়ের শিরশ্ছেদের খবরে অচেতন। জমিজমা বিক্রি করে ছেলে মামুনকে সৌদি আরব পাঠিয়েছিলেন সদর উপজেলার আবদুল্লাপাড়া গ্রামের আবদুল মান্নান। ২০০৭ সালে সর্বশেষ দেশে এসেছিলেন মামুন। ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পরই তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। ছেলেকে বাঁচানোর জন্য আবদুল মান্নান বিভিন্নভাবে সৌদি আরবে ২৫ লাখ টাকা পাঠান। কিন্তু তিনি কি সত্যি জানতেন যে ছেলের লাশটা পর্যন্ত দেখার ভাগ্য তাদের হবে না!

ফরিদপুর : সম্ভবত সবচেয়ে দুর্ভাগা শিরশ্ছেদ হওয়া সদরপুর উপজেলার মটুকচর গ্রামের আবুল। কারণ তিনি সৌদিতে গিয়ে ডাকাতি ও হত্যার ঘটনায় জড়িয়ে জেলে আছেন, এ খবর পাওয়ার পর বড় ভাই সম্পর্কচ্ছেদ করে তার সঙ্গে। আর স্ত্রী? একই গ্রামের যে তসলিমাকে ভালোবেসে ঘরে এনেছিলেন, সেই ভালোবাসার মানুষটা তাকে ছেড়ে যায় একই খবরে। কিন্তু মা কি আর সন্তানকে ছাড়তে পারেন? তাই তো পাঁচটি বছর আদরের ধন আবুলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে চোখে ছানি পড়ে গিয়েছিল কমলা বেগমের অনেক আগেই। আর কাল দেখা গেল মায়ের বুক চাপড়ানো আর্তনাদ। 'আমার মতির লাশ আইন্যা দ্যাও, নাইলে আমারে মাইর‌্যা ফেলাও। মতিরে ছাড়া আমি বাঁচুম না। তোমরা মতিরে আমার কাছে আইন্যা দ্যাও।' এভাবেই বিলাপ করতে করতে কিছুক্ষণ পর পর মূর্ছা যাচ্ছিলেন হতভাগ্য মতিয়ার রহমানের বয়োবৃদ্ধ মা সুফিয়া বেগম। মতিয়ার রহমানের বাড়ি সদর উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামে। মৃত শাহিদ খানের একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তান ছিলেন মতিয়ার। ২০০৬ সালে ধারদেনা করে মতিয়ারকে সৌদি আরবে পাঠানো হয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সৌদি আরব যাওয়ার পরপরই মতিয়ার জড়িয়ে পড়েন হত্যা ঘটনায়। ছোট ভাই দীন ইসলাম জানান, মতিয়ারের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের সর্বশেষ কথা হয়েছে বুধবার। তিনি বলেছিলেন, ভালো আছেন। শীঘ্রই জেল থেকে তিনি মুক্তি পাবেন বলে জানান। দীন ইসলাম বলেন, আমরা অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু সরকার চেষ্টা না করাতে ভাইকে হারালাম।

কুমিল্লা : 'মা, আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। এ ঘটনা সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। আমি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই। আমাকে বিনাদোষে এ ঘটনায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। মা, আমার জন্য দোয়া কর। আমি শীঘ্রই জামিনে দেশে ফিরে আসব।' শিরশ্ছেদ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে মা সাজেদা বেগমকে ফোনে এমন কথাই জানিয়েছিলেন দাউদকান্দির ফারুক হোসেন। ছেলের আবেগমাখা সেই কণ্ঠস্বর কোনোভাবেই মন থেকে মুছতে পারছেন না সাজেদা বেগম। উপজেলার মোহাম্মদপুর পশ্চিম ইউনিয়নের পিপিয়াকান্দি গ্রামের কৃষক জামাল হোসেন জানান, ২০০৪ সালে ১৫ শতাংশ জায়গা বিক্রি করে এবং সুদে টাকা নিয়ে সৌদি আরব পাঠান ছেলেকে। গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে অবশিষ্ট জমিজিরাত বিক্রি করে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা পাঠান মামলা চালানোর জন্য। সবকিছুর বিনিময়ে তিনি ছেলেকে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্য বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাদের সঙ্গে।

কিশোরগঞ্জ : 'বড় আশা কইরা আমার ফুতেরে বিদেশে পাঠাইছিলাম। অহন লাশটাও দেখতারতাম না। শেষবারের মতো তুমরা কেউ আমার ফুতের লাশটা আইন্যা দ্যাও।' শিরচ্ছেদের খবর শুনে এভাবেই আহাজারি করছিলেন পাকুন্দিয়া উপজেলার হোসেন্দী ইউনিয়নের কুমারপুর গ্রামের সুমনের মা আছিয়া খাতুন (৫৫)। শুক্রবার মা-বাবার সঙ্গে শেষবারের মতো মুঠোফোনে কথা হয় সুমনের। ফোনে তিনি জানিয়েছিলেন, আজই তার জীবনের শেষ দিন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সুমন মা-বাবার কাছে দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন। বাবা আবদুল হাইয়ের (৭৫) আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে পাকুন্দিয়ার বাতাস।

0 comments:

Post a Comment