সাড়া জাগানো ওয়েবসাইট উইকিলিকসের ফাঁস করা তারবার্তায় আবার
এসেছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। এর কয়েকটি সংক্ষেপে তুলে ধরা হল :
সাড়া জাগানো ওয়েবসাইট উইকিলিকসের তথ্যে এবার উঠে এসেছে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া। ঢাকায় নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূতের বরাত দিয়ে ২০০৯ সালের ৩০ আগস্ট ওয়াশিংটনে পাঠানো মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির তারবার্তায় বলা হয়েছিল ঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচার চান না। মরিয়ার্টি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের বর্তমান পরিবেশে বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করা হলে তা হবে রাজনীতিকীকরণ। মরিয়ার্টি বলেন, ফরাসি রাষ্ট্রদূত তাকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে বিচার না চাওয়ার কারণেই এর আগের পাঁচ বছরের শাসনামলে তিনি ইস্যুটি নিয়ে কিছুই করেননি।
মরিয়ার্টি তার পাঠানো বার্তায় বলেছেন, যুদ্ধাপরাধ ইস্যু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতির ময়দান থেকে সরানোর জন্যই এই বিচার শুরু হয়েছে। মরিয়ার্টির বিবেচনায়, এর মাধ্যমে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করা হচ্ছে। মরিয়ার্টি উল্লেখ করেন, ১৯৭৩ সালের ইন্টারন্যাশনাল
ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী যে বিচার প্রক্রিয়া চলছে, তা আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে পারেনি। যদি বিচারে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হয় তাহলে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা দরকার। আর জাতিসংঘকে জড়ানো না হলে ইস্যুটি পুরোপুরি রাজনীতিকীকরণ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে তিনি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের প্রধান একে খন্দকারের বক্তব্য তুলে ধরেন। যেখানে তিনি বিচার প্রক্রিয়া গ্রহণযোগ্য করার জন্য জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা দাবি করেন।
মরিয়ার্টি বার্তায় বলেন, বাংলাদেশের নতুন সরকার খুব দ্রুতই ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ২৯ জানুয়ারি সংসদে এ ব্যাপারে প্রস্তাব নেয়া হয়। এ কারণেই যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। সরকারি দলের অনেকেই মনে করেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারের মাধ্যমে তারা জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক ময়দান থেকে সরিয়ে দিতে পারবে।
তারবার্তায় বলা হয়, এটা এই দশকের এমন একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ইস্যু, যাকে অতিমাত্রায় রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অন্ধকারে রাখা হয়েছে।
মরিয়ার্টি তার বার্তায় বলেন, অনেক বাংলাদেশী মনে করে, ১৯৭২ সালে সিমলা চুক্তির পর বাংলাদেশ এখন যুদ্ধাপরাধের বিচার করার ব্যাপারে নৈতিক শক্তি হারিয়েছে।
তারবার্তায় বলা হয়, যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট করে। সশস্ত্র বাহিনী, প্রতিরক্ষা বাহিনী ও সহযোগী বাহিনীর লোকদের মধ্যে যারা মানবতাবিরোধী, গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিচার করার জন্য আইনটি তৈরি করা হয়। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এই আইনের অধীনে ৩৭ হাজার মানুষ আটক করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার অপরাধ সামান্য হওয়ার কারণে প্রায় ২৬ হাজার মানুষকে ক্ষমা করে দেয়। ১১ হাজারের ব্যাপারে হত্যা, ধর্ষণের মতো অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে ৭৫০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এতে আরো বলা হয়, ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান মারা যাওয়ার পর কলাবরেটর অ্যাক্ট বাতিল হয় এবং আইনে যারা জেলে রয়েছে তাদের ক্ষমা করে দেয়া হয়।
তারবার্তায় বলা হয়, সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের নেতারা অভিযোগ করেছেন, যুদ্ধকালে ৩০ লাখ বাঙালি মারা গেছে, ২ লাখ বাঙালি নারী ধর্ষিতা হয়েছে, এক কোটি মানুষ গৃহহারা হয়েছে। তারা বলছে, পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আধাসামরিক বাহিনী ছিল রাজাকার বাহিনী। এছাড়া স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে ছিল আলবদর, আলশামস এবং শান্তি কমিটি। তারা পাকিস্তানি প্রশাসনের পক্ষে কাজ করত। এতে আরো বলা হয়, ২০০৭-২০০৮ সালে কেয়ারটেকার সরকারের সময় সেক্টর কমান্ডাররা আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বিষয়টা প্রকাশ করত না। নতুন সরকার গঠনের পর এটা প্রকাশ পায়।
তারবার্তায় বলা হয়, জামায়াতে ইসলামীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামী সম্প্রতি এক রিপোর্টারকে তাদের ভুলের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্তটি ছিল ভুল এবং তা বাস্তবসম্মত ছিল না। কিন্তু আমরা কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না।’
তারবার্তায় বলা হয়, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম ও তাদের সমর্থকদের পক্ষে ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিদ্যমান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টের অধীনে। এখন তাদের প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা (বিশেষ করে জাতিসংঘ), যাতে বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও রাজনীতিমুক্ত হয়।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের প্রধান একে খন্দকার বলেছেন, ‘যদি বিচার প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘ সম্পৃক্ত হয় তাহলে বিচারটা হবে সর্বগ্রহণযোগ্য। আর যদি জাতিসংঘ এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়, তাহলে ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলেও তা বন্ধ করতে পারবে না।’ কিন্তু এ ব্যাপারে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া বাংলাদেশের। তা ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার ক্রাইম অ্যাক্ট অনুযায়ী হবে। তবে জাতিসংঘ চাইলে বিচার প্রক্রিয়া মনিটর করার জন্য পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারে। জামায়াতে ইসলামী বলছে, বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করার দাবি জানাবে।
মরিয়ার্টি তার বার্তায় মন্তব্য করেন, আওয়ামী লীগ তাদের ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নের জন্য সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারা ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে ফিরে যাচ্ছে।
তারবার্তায় বলা হয়, এই দশকে যুদ্ধাপরাধ বাংলাদেশের জন্য অতিমাত্রায় রাজনীতিপূর্ণ ইস্যু।
জেমস মরিয়ার্টি অন্য এক তারবার্তায় বলেন, পাকিস্তানের হাইকমিশনার তাকে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে ইউএনডিপি প্রতিনিধির সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতও তাকে বলেছেন, ফ্রান্স সরকার মনে করে, এ ধরনের সম্পৃক্ততা পাকিস্তান সরকারের জন্য অতিরিক্ত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তারবার্তায় বলা হয়, পাকিস্তানের হাইকমিশনার আলমগীর বাবর ১০ মে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জাতিসংঘের সম্পৃক্ততার বিষয়ে তার অসন্তুষ্টির কথা জানান। তিনি বলেন, ইউএনডিপির প্রতিনিধি রেনেটা লকের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে তার রাজনৈতিক সচিব জানিয়েছেন, ইউএনডিপি যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছে। বিশেষ করে আইনের শাসন ও সুষ্ঠু বিচারের জন্য তারা সাহায্য করছে।
১১ মে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত চার্লি কোসরেট মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বলেন, যুদ্ধাপরাধ বিচার প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের সম্পৃক্ততায় পাকিস্তানের হাইকমিশনার তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে।
রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি বার্তার শেষে মন্তব্যে বলেন, আসলে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া চলছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মাধ্যমে। আমাদের মত হচ্ছে, ১৯৭৩ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী যে বিচার প্রক্রিয়া চলছে, তা আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। যদি বিচারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হয় তাহলে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জাতিসংঘের সম্পৃৃক্ততা প্রয়োজন। যদি তা না হয়, তাহলে এটা পুরোপুরি রাজনীতিকীকরণ হয়ে যাবে।
0 comments:
Post a Comment