২০০৭ সালের শুরুর দিনগুলোতে দেশজুড়ে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র"য়ারির মতো একটি একতরফা নির্বাচন করে বিরোধী দলহীন স্বল্পমেয়াদী একটি সরকার গঠনের কথা ভেবেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কিন্তু ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়া আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এ ধরনের কোনো প্রস্তাব মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিসের গোপন তারবার্তা থেকে জানা গেছে এ তথ্য; উইকিলিকস যা প্রকাশ করেছে।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের হৈ চৈ ফেলে দেওয়া ওয়েবসাইট উইকিলিকস গত ৩০ অগাস্ট প্রায় দেড় লাখ নতুন কেবলের সঙ্গে বিউটেনিসের এ সংক্রান্ত দুটি বার্তাও প্রকাশ করেছে।
২০০৭ এর ১১ জানুয়ারি সামরিক হস্তক্ষেপে রাষ্ট্রপতি ইয়জউদ্দিন আহম্মদ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে 'ওয়ান ইলেভেন' হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ওই তারিখের মাত্র দুই দিন আগে ৮ ও ৯ জানুয়ারি ওয়াশিংটনে দুটি বার্তা পাঠান যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত।
বিউটেনিস লেখেন, সেনাবাহিনী 'বিশ্বাসভঙ্গ' করে অভ্যুত্থান করতে পারে, কিংবা দুই নেত্রীকে নির্বাসনে পাঠানো হতে পরে- এমন কোনো আশঙ্কা মনে ঠাঁই দিতে প্রস্তুত ছিলেন না সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
এ দুটি 'গুজব' উড়িয়ে দিয়েছিলেন শেখ হাসিনাও। বরং তিনি রসিকতা করে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসন দিলে তার জন্য ভালোই হবে, কেননা তাতে তিনি নাতনির সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন।
তখনকার নির্বাচন কমিশনের তফশিল অনুযায়ী ২২ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বিএনপির অনমনীয় অবস্থান; আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা সামাল দিতে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের ব্যর্থতার মধ্যে ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা এবং ৭ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন বাংলাদেশে তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস ও ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরী।
উইকিলিকসে প্রকাশিত বার্তায় বলা হয়েছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সামরিক হস্তক্ষেপ কিংবা সামরিক আইন জারি এবং দুই নেত্রীকে দেশত্যাগে বাধ্য করার মতো সম্ভবনাগুলো নিয়ে খালেদা ও হাসিনাকে 'সতর্ক' করে 'রাজনৈতিক সমঝোতার' প্রস্তাব দেন এই দুই কূটনীতিক।
দুই নেত্রীকেই তারা বলেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের একটি অংশের অনুরাধে তারা সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন এবং তাদের দেশ সামরিক অভ্যুত্থানের মতো কোনো অসাংবিধানিক ঘটনায় সমর্থন বা উৎসাহ দেবে না।
বিউটেনিস ও আনোয়ার এও বলেন- কেবল দুই নেত্রীর সাহসী পদক্ষেপের মাধ্যমেই এ রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান হতে পারে। তাদের রাজনৈতিক সমঝোতা হলেই দেশজুড়ে সহিংসতা এবং সামরিক অভ্যুত্থানের মতো পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব।
'খালেদার প্রস্তাব'
৭ জানুয়ারির একান্ত বৈঠকে কোনো ধরনের সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে খালেদা জিয়া পাল্টা অভিযোগ তোলেন- কথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যই এ ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে। তবে দুই রাষ্ট্রদূতই এ অভিযোগ অস্বীকার করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিউটেনিসের পাঠানো বার্তায়।
খালেদা দুই কূটনীতিকের কাছে দাবি করেন, তিনি সব সময়ই আওয়ামী লীগের সঙ্গে বসতে প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু শেখ হাসিনা কখনোই সাড়া দেননি।
"এখন অনেক 'দোরি হয়ে গেছে' উল্লেখ করে খালেদা জিয়া সমঝোতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং ২২ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেন। এর বদলে খালেদা প্রস্তাব দেন, পুনর্র্নিবাচিত হয়ে ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের দাবি অনুযায়ী ভোটার পরিচয়পত্র প্রবর্তনসহ নির্বাচন কমিশনের সংস্কার করে ১২ থেকে ১৫ মাসের মধ্যে তিনি আবারো নির্বাচন দিতে পারেন।"
এর আগে ১৯৯৬ সালেও এভাবে একতরফা নির্বাচন করে সংক্ষিপ্ত মেয়াদের জন্য সরকার গঠন করেছিলেন খালেদা জিয়া। সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালুর দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ওই বছর ১৫ ফেব্র"য়ারির নির্বাচন বর্জন করলে বিএনপি অবশ্যম্ভাবীভাবে পুনর্র্নিবাচিত হয়। ওই সরকারের সংক্ষিপ্ত মেয়াদে সংবিধান সংশোধন করে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা চালু করে এবং জুনে আবারো নির্বাচন দেয়, যাতে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ।
উইকিলিকসের প্রকাশিত বার্তায় বিউটেনিস লিখেছেন, ২০০৭ এর ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন হলে অনেকেই যে প্রশ্ন তুলবে- সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন খালেদা। তবে তার যুক্তি ছিল, প্রশ্ন উঠলেও তার সেই সম্ভাব্য সরকার হবে সাংবিধানিকভাবে বৈধ।
আলোচনার এক পর্যায়ে বিউটেনিস প্রশ্ন রাখেন, দেশের প্রায় অর্ধেক ভোটার যদি ২২ জানুয়ারির নির্বাচন মেনে না নেয়, সেক্ষেত্রে বিএনপি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে কি-না।
"কিন্তু দেশের মোট ভোটারের ৪০ শতাংশ আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেবে- এমন সম্ভবনা হেসেই উড়িয়ে দেন খালেদা জিয়া। বড় ধরনের গণ আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সামর্থ্য নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।"
দুই কূটনীতিক বিএনপি চেয়ারপার্সনকে জানান, সংবিধান পরিপন্থী যে কোনো ঘটনা এড়াতেই তারা রাজনৈতিক সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। এসব বিষয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গেও কথা বলেছেন তারা।
নিজের সরকারের কাছে পাঠানো বার্তায় মন্তব্যের অংশে বিউটেনিস লিখেছেন, বিএনপির একতরফা নির্বাচন পরিকল্পনার সমালোচনা করায় খালেদা জিয়া যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বলে জানতে পেরেছেন তারা। খালেদা জিয়ার ধারণা হয়েছিল, আওয়ামী লীগের পিঠ এবার সত্যি সত্যি দেওয়ালে ঠেকে গেছে এবং এ অবস্থা থেকে তারা আর ফিরে আসতে পারবে না।
'তার চেয়ে সেনা হস্তক্ষেপ শ্রেয়'
খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনার আগের দিন শেখ হাসিনার সঙ্গে বসে তাকে একই বিষয়ে সতর্ক করে সমঝোতার প্রস্তাব দেন বিউটেনিস ও আনোয়ার চৌধুরী। কিন্তু নির্বাসনে পাঠানোর সম্ভবনার বিষয়টি হেসেই উড়িয়ে দেন হাসিনা। সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা নিয়েও দুই কূটনীতিকের সঙ্গে হালকা মেজাজে কথা বলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।
৮ জানুয়ারি ওয়াশিংটনে পাঠানো বার্তায় বিউটেনিস লেখেন, "হাসিনা পুরো বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছেন। এমনকি দেশত্যাগে বাধ্য করার গুঞ্জনের বিষয়ে তিনি রনিসকতা করে বলেছেন, সেরকম কিছু হলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে নাতনির সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন। নিজের নিরাপত্তার বিষয়টিতেও খুব একটা গুরুত্ব দেননি তিনি। সরাসরি সেনা হস্তক্ষেপ বা জরুরি অবস্থা জারির সম্ভবনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, সেনাবাহিনী যদি হস্তক্ষেপ করেই এবং তারা যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতেই পারে- তাহলে সেটা ভালোই হবে।"
একবার ক্ষমতায় আসলে সেনাবাহিনী স্বেচ্ছায় আবার রাজনীতিবিদদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবে- এমনটা কেন ভাবছেন জানতে চাইলে হাসিনা মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বলেন, তেমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না বলেই তার বিশ্বাস, কেননা অভ্যুত্থান করার মতো বলিষ্ঠ কোনো নেতা সেনাবাহিনীতে নেই বলে মনে করেন তিনি।
তাছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করতে যে সময় প্রয়োজন তার বেশি সেনাবাহিনী ক্ষমতায় থাকতে চাইলে জনগণও তা মেনে নেবে না বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।
দুই কূটনীতিককে তিনি বলেন, তেমন কিছু ঘটার পর সেনাবাহিনী ক্ষমতা ছাড়তে রাজি না হলে 'দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে, রক্তপাত হবে, পুরো রাষ্ট্রই ভেঙে পড়বে'।
২০০৬ সালের শেষ দিকে বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার পর রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিলে যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়- সে জন্য বিএনপিকেই দায়ী করে শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, বিএনপি জানতো যে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগই জিতবে। এ কারণে তারা যাতে নির্বাচনে অংশ না নিতে পারে- সুপরিকল্পিতভাবে তেমনন পরিস্থিতিই সৃষ্টি করেছে বিএনপি।
রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ আবার বিএনপির হাতে ক্ষমতা তুলে দিতেই ২২ জানুয়ারি নির্বাচন আয়োজন করতে চাচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন হাসিনা।
আপাতত একতরফা নির্বাচন হলেও বিএনপি ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের দাবি পূরণ করে এক বছরের মধ্যে আবারো নির্বাচন দিতে পারে- এমন সম্ভবনার কথা তুলে ধরে দুই কূটনীতিক শেখ হাসিনার কাছে জানতে চান- খালেদা জিয়া কোনো সমঝোতার প্রস্তাব দিলে আওয়ামী লীগ তা মানবে কি না।
"জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, তিনি বরং সামরিক হস্তক্ষেপের মতো বিকল্প নিয়ে ভাবতে রাজি, বিএনপিকে আবারো ক্ষমতায় যেতে দিতে নয়," লিখেছেন বিউটেনিস।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের হৈ চৈ ফেলে দেওয়া ওয়েবসাইট উইকিলিকস গত ৩০ অগাস্ট প্রায় দেড় লাখ নতুন কেবলের সঙ্গে বিউটেনিসের এ সংক্রান্ত দুটি বার্তাও প্রকাশ করেছে।
২০০৭ এর ১১ জানুয়ারি সামরিক হস্তক্ষেপে রাষ্ট্রপতি ইয়জউদ্দিন আহম্মদ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে 'ওয়ান ইলেভেন' হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ওই তারিখের মাত্র দুই দিন আগে ৮ ও ৯ জানুয়ারি ওয়াশিংটনে দুটি বার্তা পাঠান যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত।
বিউটেনিস লেখেন, সেনাবাহিনী 'বিশ্বাসভঙ্গ' করে অভ্যুত্থান করতে পারে, কিংবা দুই নেত্রীকে নির্বাসনে পাঠানো হতে পরে- এমন কোনো আশঙ্কা মনে ঠাঁই দিতে প্রস্তুত ছিলেন না সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
এ দুটি 'গুজব' উড়িয়ে দিয়েছিলেন শেখ হাসিনাও। বরং তিনি রসিকতা করে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসন দিলে তার জন্য ভালোই হবে, কেননা তাতে তিনি নাতনির সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন।
তখনকার নির্বাচন কমিশনের তফশিল অনুযায়ী ২২ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বিএনপির অনমনীয় অবস্থান; আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা সামাল দিতে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের ব্যর্থতার মধ্যে ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা এবং ৭ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন বাংলাদেশে তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস ও ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরী।
উইকিলিকসে প্রকাশিত বার্তায় বলা হয়েছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সামরিক হস্তক্ষেপ কিংবা সামরিক আইন জারি এবং দুই নেত্রীকে দেশত্যাগে বাধ্য করার মতো সম্ভবনাগুলো নিয়ে খালেদা ও হাসিনাকে 'সতর্ক' করে 'রাজনৈতিক সমঝোতার' প্রস্তাব দেন এই দুই কূটনীতিক।
দুই নেত্রীকেই তারা বলেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের একটি অংশের অনুরাধে তারা সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন এবং তাদের দেশ সামরিক অভ্যুত্থানের মতো কোনো অসাংবিধানিক ঘটনায় সমর্থন বা উৎসাহ দেবে না।
বিউটেনিস ও আনোয়ার এও বলেন- কেবল দুই নেত্রীর সাহসী পদক্ষেপের মাধ্যমেই এ রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান হতে পারে। তাদের রাজনৈতিক সমঝোতা হলেই দেশজুড়ে সহিংসতা এবং সামরিক অভ্যুত্থানের মতো পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব।
'খালেদার প্রস্তাব'
৭ জানুয়ারির একান্ত বৈঠকে কোনো ধরনের সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে খালেদা জিয়া পাল্টা অভিযোগ তোলেন- কথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যই এ ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে। তবে দুই রাষ্ট্রদূতই এ অভিযোগ অস্বীকার করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিউটেনিসের পাঠানো বার্তায়।
খালেদা দুই কূটনীতিকের কাছে দাবি করেন, তিনি সব সময়ই আওয়ামী লীগের সঙ্গে বসতে প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু শেখ হাসিনা কখনোই সাড়া দেননি।
"এখন অনেক 'দোরি হয়ে গেছে' উল্লেখ করে খালেদা জিয়া সমঝোতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং ২২ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেন। এর বদলে খালেদা প্রস্তাব দেন, পুনর্র্নিবাচিত হয়ে ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের দাবি অনুযায়ী ভোটার পরিচয়পত্র প্রবর্তনসহ নির্বাচন কমিশনের সংস্কার করে ১২ থেকে ১৫ মাসের মধ্যে তিনি আবারো নির্বাচন দিতে পারেন।"
এর আগে ১৯৯৬ সালেও এভাবে একতরফা নির্বাচন করে সংক্ষিপ্ত মেয়াদের জন্য সরকার গঠন করেছিলেন খালেদা জিয়া। সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালুর দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ওই বছর ১৫ ফেব্র"য়ারির নির্বাচন বর্জন করলে বিএনপি অবশ্যম্ভাবীভাবে পুনর্র্নিবাচিত হয়। ওই সরকারের সংক্ষিপ্ত মেয়াদে সংবিধান সংশোধন করে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা চালু করে এবং জুনে আবারো নির্বাচন দেয়, যাতে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ।
উইকিলিকসের প্রকাশিত বার্তায় বিউটেনিস লিখেছেন, ২০০৭ এর ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন হলে অনেকেই যে প্রশ্ন তুলবে- সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন খালেদা। তবে তার যুক্তি ছিল, প্রশ্ন উঠলেও তার সেই সম্ভাব্য সরকার হবে সাংবিধানিকভাবে বৈধ।
আলোচনার এক পর্যায়ে বিউটেনিস প্রশ্ন রাখেন, দেশের প্রায় অর্ধেক ভোটার যদি ২২ জানুয়ারির নির্বাচন মেনে না নেয়, সেক্ষেত্রে বিএনপি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে কি-না।
"কিন্তু দেশের মোট ভোটারের ৪০ শতাংশ আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেবে- এমন সম্ভবনা হেসেই উড়িয়ে দেন খালেদা জিয়া। বড় ধরনের গণ আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সামর্থ্য নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।"
দুই কূটনীতিক বিএনপি চেয়ারপার্সনকে জানান, সংবিধান পরিপন্থী যে কোনো ঘটনা এড়াতেই তারা রাজনৈতিক সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। এসব বিষয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গেও কথা বলেছেন তারা।
নিজের সরকারের কাছে পাঠানো বার্তায় মন্তব্যের অংশে বিউটেনিস লিখেছেন, বিএনপির একতরফা নির্বাচন পরিকল্পনার সমালোচনা করায় খালেদা জিয়া যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বলে জানতে পেরেছেন তারা। খালেদা জিয়ার ধারণা হয়েছিল, আওয়ামী লীগের পিঠ এবার সত্যি সত্যি দেওয়ালে ঠেকে গেছে এবং এ অবস্থা থেকে তারা আর ফিরে আসতে পারবে না।
'তার চেয়ে সেনা হস্তক্ষেপ শ্রেয়'
খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনার আগের দিন শেখ হাসিনার সঙ্গে বসে তাকে একই বিষয়ে সতর্ক করে সমঝোতার প্রস্তাব দেন বিউটেনিস ও আনোয়ার চৌধুরী। কিন্তু নির্বাসনে পাঠানোর সম্ভবনার বিষয়টি হেসেই উড়িয়ে দেন হাসিনা। সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা নিয়েও দুই কূটনীতিকের সঙ্গে হালকা মেজাজে কথা বলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।
৮ জানুয়ারি ওয়াশিংটনে পাঠানো বার্তায় বিউটেনিস লেখেন, "হাসিনা পুরো বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছেন। এমনকি দেশত্যাগে বাধ্য করার গুঞ্জনের বিষয়ে তিনি রনিসকতা করে বলেছেন, সেরকম কিছু হলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে নাতনির সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন। নিজের নিরাপত্তার বিষয়টিতেও খুব একটা গুরুত্ব দেননি তিনি। সরাসরি সেনা হস্তক্ষেপ বা জরুরি অবস্থা জারির সম্ভবনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, সেনাবাহিনী যদি হস্তক্ষেপ করেই এবং তারা যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতেই পারে- তাহলে সেটা ভালোই হবে।"
একবার ক্ষমতায় আসলে সেনাবাহিনী স্বেচ্ছায় আবার রাজনীতিবিদদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবে- এমনটা কেন ভাবছেন জানতে চাইলে হাসিনা মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বলেন, তেমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না বলেই তার বিশ্বাস, কেননা অভ্যুত্থান করার মতো বলিষ্ঠ কোনো নেতা সেনাবাহিনীতে নেই বলে মনে করেন তিনি।
তাছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করতে যে সময় প্রয়োজন তার বেশি সেনাবাহিনী ক্ষমতায় থাকতে চাইলে জনগণও তা মেনে নেবে না বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।
দুই কূটনীতিককে তিনি বলেন, তেমন কিছু ঘটার পর সেনাবাহিনী ক্ষমতা ছাড়তে রাজি না হলে 'দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে, রক্তপাত হবে, পুরো রাষ্ট্রই ভেঙে পড়বে'।
২০০৬ সালের শেষ দিকে বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার পর রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিলে যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়- সে জন্য বিএনপিকেই দায়ী করে শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, বিএনপি জানতো যে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগই জিতবে। এ কারণে তারা যাতে নির্বাচনে অংশ না নিতে পারে- সুপরিকল্পিতভাবে তেমনন পরিস্থিতিই সৃষ্টি করেছে বিএনপি।
রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ আবার বিএনপির হাতে ক্ষমতা তুলে দিতেই ২২ জানুয়ারি নির্বাচন আয়োজন করতে চাচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন হাসিনা।
আপাতত একতরফা নির্বাচন হলেও বিএনপি ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের দাবি পূরণ করে এক বছরের মধ্যে আবারো নির্বাচন দিতে পারে- এমন সম্ভবনার কথা তুলে ধরে দুই কূটনীতিক শেখ হাসিনার কাছে জানতে চান- খালেদা জিয়া কোনো সমঝোতার প্রস্তাব দিলে আওয়ামী লীগ তা মানবে কি না।
"জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, তিনি বরং সামরিক হস্তক্ষেপের মতো বিকল্প নিয়ে ভাবতে রাজি, বিএনপিকে আবারো ক্ষমতায় যেতে দিতে নয়," লিখেছেন বিউটেনিস।
0 comments:
Post a Comment